লামা ও আলীকদম অংশে অস্বাভাবিকভাবে নদীর নাব্যতা হ্রাস
লামা প্রতিনিধি :: প্রমত্তা মাতামুহুরী নদীর তলদেশ জুড়ে এখন সবুজ ফসলের মাঠ। লামা ও আলীকদম অংশে অস্বাভাবিক ভাবে নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে পুরো নদী জুড়ে জেগে উঠেছে অসংখ্য বালির চর। অব্যাহত বৃক্ষনিধন, জুম চাষ, নদীর তীরে তামাক চাষ এবং বিধি বর্হিভূতভাবে পাথর আহরণের বিরূপ প্রভাবে মাতামুহুরী গত এক দশকে দ্রুত নাব্যতা হারিয়ে শুস্ক মৌসুম এলেই মরা নদীতে পরিণত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যেরে সীমান্তে অবস্থিত ক্রাউডং বা ময়বার পর্বতমালা থেকে মাতামুহুরী নদী উৎপন্ন হয়ে আলীকদমের রিজার্ভ বনভূমির উপর দিয়ে সর্পিল গতিতে প্রবাহিত হয়ে উত্তর দিকে লামা উপজেলা পর্যন্ত এসে পশ্চিম দিকে কক্সবাজারের চকরিয়া অভিমুখে প্রবাহিত হয়ে গেছে। এ নদীর মূল উৎপত্তি স্থান থেকে ৩২৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ১২টি খাল ও ৫৪ টি ঝিরি নিয়ে চকরিয়া উপজেলার বেতুয়া বাজারের কাছে দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে মহেশখালী চ্যানেলে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। মাতামুহুরী নদীর সাথে এর আশ–পাশের লোকজনের জীবন জীবিকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
এ নদীটি তার অববাহিকায় বসবাসকারি জনগোষ্টির সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে মূখ্য ভূমিকা পালন করছিলো। তবে গত কয়েক দশক ধরে এক শ্রেনীর লোভী মানুষের কালো থাবায় বিভিণ্ন ধরনের আগ্রাসনের শিকার হয়ে নদীটির নাব্যতা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়ে ঐতিহ্যবাহি এ নদী হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এ নদীর যেখানে অথৈ পানি আর বিভিন্ন প্রজাতির মাছ থাকার কথা, সেখানে এখন বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদ।
লামা ও আলীকদম অংশে অস্বাভাবিকভাবে নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় নদীর তলদেশের প্রায় পুরো অংশ জুড়ে এখন সবুজ ফসলের মাঠ। উপর থেকে নেমে আসা পাহাড়ি বালি আর মাটি জমে নাব্যতা হারানোর কারণে পুরো নদী জুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল আকারের বালির চর। স্থানীয় জনসাধারণ সে চরে নির্বিঘ্নে চলতি মৌসুমে ফলাচ্ছে বিভিন্ন ফসল।
গত এক দশক পূর্বেও এ নদীর গভীরতা ছিল ২৫/৩০ ফুট। বর্তমানে পুরো নদীর দু’এক জায়গা ব্যতিত কোথাও গভীরতা খুজেঁ পাওয়া যায় না । জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ি ছড়া ও ঝিরি থেকে মাটি খনন করে এবং বারুদের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে গত কয়েক বছর যাবত ব্যাপক হারে পাথর আহরণের ফলে আবহমান কাল থেকে পাথরের বেষ্টুনি দিয়ে গড়ে উঠা পাহাড় গুলো বর্ষা মৌসুমে ধ্বসে পড়ে। অপরদিকে, লামা ও আলীকদমের বিভিন্ন পাহাড় থেকে যুগ যুগ ধরে বৃক্ষ নিধন এবং জুমিয়া পরিবারগুলো জুম চাষের সুবিধার্থে পাহাড়ের উপরিভাগে অগ্নি সংযোগের ফলে পাহাড়গুলো ন্যাড়া পাহাড়ে পরিনত হয়।
বর্ষা মৌসুমে ন্যাড়া পাহাড়গুলো বৃষ্টির পানি ধারণ করে রাখতে পারেনা। দ্রুত গতিতে বৃষ্টির পানি পাহাড়ি ঝর্ণা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এসময় স্রোতের সাথে ধসে পড়া পাহাড়ের বালি ও মাটি মাতামুহুরী নদীতে জমে নদীর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে। গত ৩/৪ বছর ধরে অস্বাভাবিক ভাবে এ নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় এলাকার মানুষ আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতে মাতামুহুরী নদী পরিপূর্ণ হয়ে দু’কুল ফেঁপে উঠে লামা ও আলীকদমে বন্যার সৃষ্টি করে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
অপরদিকে, সম্প্রতি বছর গুলোতে এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাতামুহুরী নদীর তীর কেটে এবং পাহাড়ি ঝিরির (খাল) পাড় কেটে তামাক চাষ। বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের পানিতে নদীর তীরে পলি জমে। আর এ পলিতে তামাক চাষ ভালো হয়। পাশাপশি নদীর তীরে তামাক চাষের জন্য পানি প্রাপ্তির সুবিধা বেশি থাকার ফলে স্থানীয় তামাক চাষীরা মাতামুহুরী নদীর দু’তীরে তামাক চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে।
নদীর তীরে তামাক চাষের জন্য চাষীরা অপিরকল্পিতভাবে নদীর দু’তীর কেটে তামাক চাষের উপযোগী করে তোলে। তার পর সেখানে বোরো ও রবি মৌসুমে চাষীরা তামাক চাষ করে । সরেজমিনে পরিদর্শনকালে আলীকদম সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা, রেপারপাড়া, সোনাইছড়ি, শিলের তুয়া, হরিণঝিরি, দরদরী, মেরাখোলা, বইলারচর, বমুবিলছড়ি এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় মাতামুহুরী নদীর দু’তীর এবং পাহাড়ি ঝিরির (খাল) দু’পাড় কেটে কৃষকদের চলতি মৌসুমে ব্যাপকহারে তামাক চাষ করতে দেখা গেছে।
আলীকদমের চৈক্ষ্যং এলাকার বাসিন্দা বৃদ্ধ আবুল কালাম চকরিয়া নিউজকে জানান, এক সময় এ নদীতে প্রচুর গভীরতা ছিলো। যেখানে ছিলো অথৈ পানি, এখন সেখানে বালি আর মাটির স্তুপ। তিনি বলেন গত দশ বছরে মাতামুহুরী ব্যাপকভাবে ভরাট হয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীর এ অস্বাভাবিক নাব্যতা হ্রাসের ফলে বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢলে নদীর দু’কূল উপছে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে বলে নদী তীরবর্তী বসবাসকারীরা মনে করছেন ।
পাঠকের মতামত: